বৃদ্ধাশ্রম (Briddhashrom)- গল্প

বৃদ্ধাশ্রম (Briddhashrom)

আরাফ আহমেদ ডিটিভির একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক । গত ৩ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছে।নতুন নতুন কাজ দিয়ে চ্যানেলটাকে অনেক এগিয়ে নিয়েছেন।তাই অফিসে তার সম্মানটা বেশি।সবাই জানে আরাফ আহমেদ অনেক সৃজনশীল আর ভালো মনের মানুষ।নতুন নতুন শো,উপস্থাপনে নতুনত্ব দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।ফেসবুকেও ভালো জনপ্রিয়।লাখের কাছাকাছি ফলোয়ার তার।টিভির অনুষ্ঠান দিয়ে মানুষকে অনেক সচেতন করেছেন তিনি।একটা পত্রিকায় ইন্টারভিউতে আরাফ আহমেদ বলেছিলেন,মানুষকে সচেতন করতে, মানবিক দিক ও নতুন কিছু শিখাতে ভালোবাসি।ইন্টারভিউতে­­­ জানতে চাওয়া হয়েছিল,আপনার পরিবারে কয়জন আছে?পরিবারকে কতটুকু সময় দিতে পারেন??
উত্তরে বলেছিলেন,আমার পরিবারে আমার স্ত্রী একটা ছেলে এবং আমি।পরিবারকে খুব কম সময় দেওয়া হয়।খুব ব্যস্ত থাকতে হয় তাই।
দর্শক চায় ডিটিভির প্রায় অনুষ্ঠানে আরাফ আহমেদ থাকবেন তাই তার চাপ বেশি।আজ অফিসের বস আরাফ আহমেদকে ডেকে বললেন,এখনকার বিকেলের শো এই মাসে শেষ হয়ে যাবে।আগামি মাস থেকে নতুন শো করতে হবে।আমি চাই এই শো তুমি করবে।নতুন কিছু আনবে যাতে পাবলিক খায়।বস এর কথায় রাজি হতে হয় আরাফ আহমেদকে।নতুন কিছু খুঁজতে থাকে আরাফ।পরের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা পড়তে বসে আরাফ আহমেদ।পাতা পালটানোর সময় চোখে পড়ল একটা শিরোনাম, সুযোগ সুবিধার অভাব আহসান আলী বৃদ্ধাশ্রমে।এই শিরোনাম দেখে মাথায় একটা ভাবনা চলে আসল।অফিসে গিয়ে বসকে ভাবনাটা বলে সব পরিকল্পনা করতে লাগল।শো টা হবে বৃদ্ধাশ্রমের মা বাবাদের গল্প নিয়ে।এই মাসের ২২ তারিখে আরাফ আহমেদের পরিকল্পনায় ও উপস্থাপনায় নতুন শো এর রেকর্ডয়িং হবে।অফিস থেকে গাজীপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হলো আরাফ ও তার সহকর্মীদের।আড়াই ঘন্টা যাত্রার পর সেখানে গিয়ে পৌছাল তারা।আগে থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের কতৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।তারা একজন বৃদ্ধ মহিলাকে বাছাই করে রেখেছে আগে থেকে তার গল্প বলার জন্য।রেকর্ডয়িং এর প্রথমে আরাফ আহমেদ আবারো তার নিজস্ব নতুনত্ব দিয়ে শুরু করে।এরপর বৃদ্ধাশ্রমটি দেখায়।কিছু কথা বলে যারা বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেয় তাদের নিয়ে।তাদের প্রতি ঘৃনা প্রকাশ করেন।এ সময় একটু ভেবে আরাফ আহমেদ আনমনা হয়ে পড়ে।এবার সেই বৃদ্ধা মহিলার গল্প শোনার পালা।রেকর্ডয়িংটা হবে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায়।মহিলা আগে থেকেই বসে ছিলেন।আরাফ আহমেদ এসে বিস্মিত হয়ে গেল।কিছু না বলেই বসে পড়ল।একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে।বারবার ঘেমে উঠছেন আর টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছেন।একারনে বার বার টেক নিতে হচ্ছে।ক্যামেরাম্যান অবাক দৃস্টিতে তাকিয়ে আছে আরাফ আহমেদের দিকে।আগে অনেক কঠিন কঠিন রেকর্ডয়িংয়েও এতো টেক সে নেয়নি।আরাফ আহমেদ আগে থেকেই ভেবে রেখেছে মহিলাকে মা বলে সন্মধোন করবেন।আরাফ আহমেদ প্রথম প্রশ্ন করলেন মহিলাকে, আপনি কেমন আছেন মা??

 
এই প্রশ্ন করার সময় তার মনে পড়ল প্রায় ২ বছর পর মাকে মা বলে ডাকার সুযোগ পেল।মা কথাটি বলার সাথে সাথে আরাফ আহমেদের শরীরটা কেঁপে উঠলো।তার সামনে বসে আছে তার মা।আগে থেকে জানলে হয়ত সে এই এখানে আসত না।তার মা উত্তর দিল, ছেলেকে ছাড়া পরিবার ছাড়া কি করে ভালো থাকি বাবা??
আরাফ আহমেদ অবাক হয়ে গিয়েছে, তার মা কী তাকে চিনতে পাচ্ছে না??নাকি রাগ করে ছেলে বলে পরিচয় দিচ্ছে না।আর ভাবছে, ভালোই হলো পরিচয় দিলে আমার সাথের মানুষগুলো আমাকে ঘৃনা করবে আমার সম্পর্কে খারাপ ধারনা পোষণ করবে।
আপনি কয় বছর এই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন?(আরাফ)
-দুই বছর চার মাস হয়েছে বাবা(আরাফের মা)
-আপনার পরিবারে কে কে ছিল??
-আমার ছেলে,আমার ছেলের বউ।আর আমার নাতি। আমার স্বামী ছেলের জন্মের ছয় বছর পরেই মারা যায়।
-আপনার ছেলে কি করে??
-আপনার মতোই টিভিতে চাকরি করে।
আরাফ আহমদের মনে পড়ল,মা আমাকে চিনবেই না কেন?তাহলে কি আমার সম্মান বাচানোর জন্য মা বলে পরিচয় দিচ্ছে না??
মায়ের উত্তরে আরাফ আহমেদ বলে,কী কারনে আপনাকে আপনার ছেলে এখানে রেখে গিয়েছে কেনো??পুরো গল্পটা যদি বলতেন তাহলে আমাদের দর্শক সব বুঝতে পারবে।আরাফের মা শুরু করে,
আমার বিয়ে হয় গরিব একটা পরিবারে। তখন আমি ইন্টারে পড়ি।পরীক্ষার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর ভালোমতেই সব চলছিল।আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির বিষয় ছিল আমার ছেলের জন্ম।পরিবারে সুখের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু ছেলের ছয় বছরেও ওর বাবা মারা যায়। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে মানুষ করি।সেই কস্ট কথা কি বলব।
আরাফ আহমেদ সপ্নেও ভাবে নি মায়ের ইন্টারর্ভিউ নিবে এই বৃদ্ধাশ্রমে।আজকে প্রথম দিকের পর একবারও টেক নিচ্ছে না।আরাফ আহমেদের মা এবার একটু থেমে আবারো বলা শুরু করল, ছেলেটাকে পড়ালেখা করিয়েই বড় করেছি।ছেলে আমাকে অনেক ভালোবাসত।ছেলেটা প্রথম চাকরি পেয়ে যখন আমাকে একটা শাড়ি দিল তখন মনে হয়েছিল ছেলে আমাকে পুরো পৃথিবী হাতে এনে দিয়েছে।একসময় ছেলের বিয়ে দেই।পরিবারেই সদস্য বাড়ে।ছেলের বউকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম।বিয়ের কয়েকমাস পর বৌ এর বড় বোন বেড়াতে আসে আমাদের বাড়িতে।এরপর থেকে বৌ এর আচরনে ভিন্নতা দেখতে পেলাম।ভেবেছিলাম হয়ত মন খারাপ তাই।কিছুদিন পর আবার ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু দিন দিন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কিছুই বলিনি।একদিন ছেলের বউকে বলি,মা আমাকে ওষধটা দেও তো।কিন্তু একথা শুনে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে।আমাকে বলে,কাজ করে খেতে পারেন না?? অসুখ এর নামে আর কতো অভিনয় করে কাজে ফাঁকি দিবেন??খুব কস্ট পেয়েছিলাম বলেছিলা, তোমার এমন আচরণ আশা করিনি।তুমি বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছ। এরপর অনেক অকথ্য বাসায় আমাকে বকাঝকা করে।ছেলে আসার পর কেঁদে কেঁদে বিচার দেয় আমার নামে আমি নাকি খারাপ ভাষায় তাকে গালি দিয়েছি এবং মারতে গিয়েছি।ছেলে রেগে যায়। আমার কথা না শুনেই আমাকে ঝাড়ি দিয়েছে আমার ছেলে।একজন।আমার সাথে কিভাবে এতো খারাপ ব্যবহার করল তা মেনে নিতে কস্ট হচ্ছে।ছেলেটা আসল কথা না জেনেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।বউ এর দোষ দেখল না।এরপর থেকে ছেলে আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না। মা বলে ডাকে না।আর ছেলের বউ তখন থেকে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করে।কিছুদিন পর ছেলের বউ আমাকে চোরের অপবাদ দেয়।আমি নাকি তার গহনা চুরি করেছি।বাবা সত্যি কথা বলছি আমি চুরি করি নাই।ওর বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন না খেয়েছিলাম কিন্তু কখনো চুরি করিনি। চুরি করার কথা মাথাতেও আনিনি।কিন্তু সেদিন আমার ছেলে আগের বারের মতো ঝাছাই না করেই চোর বলে।কেঁদেছিলাম খুব কেঁদেছিলাম।
মায়ের এই কথা শোনার সময় টেক নিয়ে আড়ালে গিয়ে চোখ মুছে নেয়।তারপর এসে আবার গল্প শুরু করতে বলে।
-পরেরদিন ছেলে অফিসে যাওয়ার পর ছেলের বউ বলে,আপনাকে আপনার ছেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে।আমিও চাই আরেকবার যাতে আপনাকে এই কথা না বলতে হয় তার আগেই যেনো আপনাকে বাড়ির বাইরে দেখি।
চলে গেলাম।ওই বাড়িতে চোরের অপবাদ নিয়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো।বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে যাইনি।এরপর এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে থাকি।একা খুব একা লাগে।


Image result for briddhashrom 

-আপনি কি আপনার ছেলেকে অভিশাপ দেন এই কস্ট দেওয়ায় জন্য?
-না বাবা অভিশাপ দেই না। এখনো নামাজ পড়ে দোয়া করি।
-আপনার ছেলে যদি আপনার কাছে ক্ষমা চায় ক্ষমা করবেন???
-কেনো করব না??ও তো আমার গর্ভে থাকা আমার রত্ন আমার ছেলে।
আরাফ আহমেদ আর কিছু না ভেবে মায়ের পায়ের নিচে পড়ে কাঁদতে লাগল।ক্যামেরাম্যান অবাক হয়ে আছে।ক্যামেরা বন্ধ করছে না।কাঁদতে কাঁদতে আরাফ বলে মা মাফ করে দাও মা।ভুল করেছি আমি। তোমাকে ভুল বুঝেছি।সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছি।মা তোমার এই কুলাংগার ছেলেকে মাফ করে দাও ।ছোট বেলার মতো তোমার আরাফকে মাফ করে দাও মা।মা আরাফকে বুকে টেঁনে নিয়ে কাঁদতে লাগল।
-বাবা আমি আজ সব ভুলে গেছি।তুই তো আমারই ছেলে আমার রত্ন।মা ছেলের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে।ক্যামেরাম্যান এবং আরাফ আহমেদের বাকি সব সহকর্মীর বুঝতে বাকি রইল না ইনি আরাফ আহমেদের মা।কিছুক্ষন পর ক্যামেরাম্যান আরাফ আহমেদকে জিজ্ঞেস করল, আরাফ সাহেব শেষের ভিডিওটুকু কি ডিলেট করে দিব??
-না!! এটা সহই টিভিতে দেখাব

লেখাঃ Sahid Islam
বৃদ্ধাশ্রম (Briddhashrom)- গল্প বৃদ্ধাশ্রম (Briddhashrom)- গল্প Reviewed by Sahidul Islam Sahid on June 08, 2019 Rating: 5

No comments: